WhatsApp Icon

Blog

Date: 03-12-2024, 02:27 pm

Author: আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ

সদাচরণ এবং আত্ম-উন্নয়ন




সদাচরণ এবং আত্ম-উন্নয়ন

(ইসলামে ভালো চরিত্র গঠনের উপায়

আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ

সদাচরণ কী?

সদাচরণের আরবী প্রতিশব্দ (اَلْبِرُّ وَالصِّلَةُ وَالرِّفْقُ وَالرَّحْمَةُ) اَلْبِرُّ এটি পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর الصلة হলো আত্মীয়-স্বজন অর্থ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। কোনো বিনিময় ছাড়াই নিকট আত্মীয় অথবা দূর সম্পর্কের আত্মীয় সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। الرفق অর্থ কোমলতা। সেটা হতে পারে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, হিন্দু-মুসলিম কিংবা পশু-পাখির সাথে। والرحمة অর্থ দয়া করা। ছোট-বড়, ইয়াতীম-মিসকীন, পথিক, দূর সম্পর্কের আত্মীয়, নিকট আত্মীয়, পিতা-মাতা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পশু-পাখি সবার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। আর সদাচরণের বিপরীত হলো দুরাচরণ। আর দুরাচরণের আরবী প্রতিশব্দ (اَلْعنْفُ وَالْفُحْشُ وَالْجَوَّاظُ وَالْجَعْظَرِىُّ) العنف অর্থ কঠোর স্বভাব, الْفُحْشُ অর্থ অশ্লীলতা, الْجَوَّاظُ  الْجَعْظَرِىُّ  অর্থ মন্দ স্বভাব, কর্কশ ভাষা।

উপরের আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, ব্যক্তির কোমলতা, ভদ্রতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা; মানুষ, পশু-পাখি প্রভৃতি সবার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং কঠোরতা, অশ্লীল ও কর্কশ ভাষী হওয়া থেকে মুক্ত থাকাকে সদাচরণ বলে।

 

সদাচরণের গুরুত্ব

সদাচরণের অপর নাম حُسْنُ الْخُلُقِ অর্থ উত্তম চরিত্র। আর এটা যাবতীয় উত্তম গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ এবং যাবতীয় মন্দ হতে বিরত থাকা। যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী তারাই সদাচরণ করতে পারে। আমাদের রাসূল a ছিলেন সদাচারী, উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাই মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِيْمٍ নিশ্চয় আপনি চরিত্রের উচ্চস্তরে আছেন (আল-ক্বালাম, ৬৮/৪)

 

বস্তুত, নম্রতা ও কোমলতা ব্যক্তির সৌন্দর্যবর্ধক। আর যেখান থেকে নম্রতা ও কোমলতা প্রত্যাহার করা হয় তা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে।

আর সদাচরণ বা কোমলতা কেবল মানুষের আচরণের সাথে সম্পৃক্ত। এই মহৎ গুণ মানুষ ছাড়া কোনো পশু-পাখি বা জড়বস্তুর মধ্যে থাকতে পারে না।

তাই সদাচরণের গুরুত্ব মানব জীবনে অপরিসীম। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ اِدْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ

ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন উৎকৃষ্ট দ্বারা। ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো (হা-মীম সাজদা, ৪১/৩৪)

عَنْ جَرِيْرٍ عَنِ النَّبِيِّ : «‌منْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ» 

জারী c বলেন, রাসূল a বলেছেন, যাকে কোমলতা বা নম্রতা হতে বঞ্চিত করা হয়, তাকে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়(ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯২; মিশকাত, হা/৫০৬৯)।  

 

সদাচরণের উপায় বা পন্থা

(ক) সদাচরণের উপায় লজ্জাশীলতা

সদাচরণ অবলম্বন করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন লজ্জাশীলতা। লজ্জা ছাড়া সদাচরণ করা যায় না। কারণ যখন কোনো লোকের লজ্জা থাকে না, তখন সে দুরাচরণ করলেই কী আর সদাচরণ করলেই কী!

তাই যার লজ্জা নেই সে সদাচরণ করতে পারে না। নির্লজ্জতা হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে রাসূল a-এর বাণী,

 عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  مَرَّ عَلٰى رَجُلٍ مِنَ الأَنْصَارِ وَهُوَ يَعِظُ أَخَاهُ فِي الْحَيَاءِ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «‌دَعْهُ فَإِنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الْإِيْمَانِ».

ইবনু উমার c বলেন, যখন রাসূল a এক আনছারী ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সে তার ভাইকে লজ্জা করার ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছিল। এ সময় রাসূল a বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও।

কারণ লজ্জা হলো ঈমানের অংশ’ (ছহীহ বুখারী, হা/২৪; আব দাউদ, হা/৪৭৯৫; মিশকাত, হা/৫০৭০)

অপর বর্ণনায় রাসূল a বলেন,

يَا عَائِشَةُ «‌لَوْ كَانَ الْحَيَاءُ رَجُلًا لَكَانَ رَجُلًا صَالِحًا، وَلَوْ كَانَ الْفُحْشُ رَجُلًا لَكَانَ رَجُلَ سَوْءٍ».

হে আয়েশা! যদি কোনো লোক লজ্জাশীল হয়, তাহলে সে হবে সৎ ব্যক্তিআর যদি লজ্জাহীন হয়, তাহলে নিশ্চয় সে হবে নিকৃষ্ট লোক (মাকারিমুল আখলাক, হা/৮৯; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪৭১৮)

(খ) সদাচরণের উপায় ভালোবাসা

 সদাচরণ অবলম্বন করার জন্য একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসা। মানুষ যখন পরস্পরকে ভালোবাসে তখন তার দোষ-ত্রুটি সবকিছু মুছে যায়। ফলে তার সাথে লেনদেন করা সহজ হয়।

তার দোষ-ত্রুটি ঢাকা থাকে। রাসূল a বলেছেন, ভালোবাসা ছাড়া মানুষ পূর্ণ মুমিন হতে পারে না। আর পূর্ণ মুমিন হওয়া ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না,


পরস্পরকে ভালোবাসা সদাচরণের একটি মহৎ গুণ, যে যাকে যত ভালোবাসে সে তার সাথে তত সদাচরণ করতে পারে।

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «إِنَّ اللهَ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: أَيْنَ الْمُتَحَابُّوْنَ بِجَلَالِيْ؟ اَلْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِيْ ظِلِّيْ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّيْ».

আবূ হুরায়রা c বলেন, রাসূল a বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, যারা আমার মর্যাদার খাতিরে পরস্পরে ভালোবাসা স্থাপন করেছে, তারা কোথায়? আজ আমি তাদের আমার বিশেষ ছায়ায় স্থান দিব।

আজ এমন দিন, আমার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া নেই (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪৩৬; মিশকাত, হা/৫০০৬)

 

(গ) সদাচরণের উপায় ক্ষমা

 সদাচরণ করার জন্য আরেকটি মহৎ গুণ হলো ক্ষমা। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই পরস্পরকে ক্ষমা করতে হবে। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল a-কে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যম হিসাবে ক্ষমাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। 

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ t قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «‌مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ شَيْئًا وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلَّا عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلّٰهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ».

আবূ হুরায়রা c হতে এ হাদীছটিও বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ a বলেছেন, দান (ছাদাকা) ধন-সম্পদ কমায় না। যে ব্যক্তি কারো অপরাধ ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।

আর যে শুধু আল্লাহরই জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৮; মিশকাত, হা/১৮৮৯)

(ঘ) সদাচরণের উপায় নম্রতা ও কোমলতা 

সদাচরণের জন্য মহৎ গুণ হচ্ছে নম্রতা, ভদ্রতা ও কোমলতা। যার মধ্যে নম্রতা নেই, তার মধ্যে সদাচরণের অন্যান্য গুণাবলি থাকা দুরূহ।

  عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ:قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ وَبِمَنْ تَحْرُمُ النَّارُعَلَيْهِ؟عَلٰى كُلِّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ قَرِيْبٍ سَهْلٍ».

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ c বলেন, রাসূল a বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন লোকের সংবাদ দিব না, যার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায় আর আগুনও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না? 

এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যার মেজাজ নরম, স্বভাব কোমল, মানুষের নিকটতম (মিশুক) এবং আচরণ সরল সহজ’ (তিরমিযী, হা/২৪৮৮; আত-তারগীব, হা/; মিশকাত, হা/৫০৮৪)

 


সদাচরণের আরও কিছু দিক

. অতিথিদের যথাযোগ্য সম্মান ও যত্নসহকারে আপ্যায়ন করা
. অপ্রয়োজনীয় কথা, মিথ্যা ও কটূক্তি থেকে বিরত থাকা
. প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক
. সামাজিক সম্পর্কের শুরুতে সালাম জানানো ও অনুমতি নেওয়া
. সদা হাসিমুখে ও আনন্দময় আচরণ বজায় রাখা
. প্রতিটি মানুষের সাথে সদাচরণ করা ইসলামের নির্দেশ
. পিতা-মাতার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও যত্ন প্রদর্শন
. রক্তসম্পর্ক রক্ষা করা ও আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা
. ইয়াতীম ও মিসকীনের প্রতি সহমর্মী ও দানশীল হওয়া
১০. প্রতিবেশীর প্রয়োজন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
১১. দাস-দাসী ও কাজের মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করা
১২. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখা
১৩. রোগীর সেবা ও উৎসাহ প্রদান করা
১৪. ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার প্রতি ন্যায়পরায়ণ ও উদার হওয়া
১৫. অমুসলিমদের সাথে ন্যায়বিচার ও সৌহার্দ্য বজায় রাখা
১৬. পশু-পাখির প্রতি দয়াশীল ও যত্নশীল হওয়া

সদাচরণের বিপরীত দুরাচরণ

. রুক্ষ স্বভাব: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ কোমল স্বভাবকে ভালোবাসেন” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 2593)

. অহংকার: “যার অন্তরে এক বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 91)

. যুলম: আল্লাহ বলেছেন, “আমি নিজের ওপর যুলম করা হারাম করেছি” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 2577)

. কৃপণতা: “কৃপণতা ও ঈমান কখনো একই অন্তরে থাকতে পারে না” (তিরমিযি, হাদিস: 1961)

. চোগলখোরি ও পরনিন্দা: “চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না” (সহীহ বুখারি, হাদিস: 6056)

. মিথ্যা বলা: “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ আছে: যখন কথা বলে মিথ্যা বলে” (সহীহ বুখারি, হাদিস: 33)

. প্রতারণা করা: “যে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 102)

. হিংসা করা: “তোমরা একে অপরের বিরুদ্ধে হিংসা করো না” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 2564)

. অবজ্ঞা করা: “মুসলিম তার ভাইকে অবজ্ঞা করবে না” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 2564)

১০. নিন্দা করা: “তুমি কি জান, গীবত কী? কারও অনুপস্থিতিতে তার এমন কিছু বলা যা তাকে অপছন্দ” (তিরমিযি, হাদিস: 1934)

১১. অন্যের অধিকার হরণ: “যে ব্যক্তি কারো অধিকার নষ্ট করবে, কেয়ামতের দিন তা ফিরিয়ে দিতে হবে” (সহীহ বুখারি, হাদিস: 2449)

১২. অসভ্য ভাষা ব্যবহার: “মুসলিম গালি দেয় না” (তিরমিযি, হাদিস: 1977)

১৩. গীবত করা: “গীবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতো” (কুরআন: সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)

১৪. উগ্র আচরণ করা: “উগ্রতা থেকে দূরে থাকো” (তিরমিযি, হাদিস: 2015)

১৫. দায়িত্ব অবহেলা করা: “প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করবে” (সহীহ বুখারি, হাদিস: 893)

 

উপসংহারে বলা যায়, সদাচরণ একটি মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক যা তার নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজে তার ভূমিকার ভিত্তি গঠন করেইসলামের দৃষ্টিতে সদাচরণের গুরুত্ব অপরিসীম, যা মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমরাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সদাচরণের নিদর্শন রয়েছে, যা অনুসরণ করলে ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারেতাই সদাচরণ চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের উন্নতি সম্ভব