Blog

মব (mob) সাইকোলজি 

(উৎসুক জনতার মনোবিজ্ঞান) 

সাঈদ আল-মাহমুদ 

~ ভূমিকা  

সাইকোলজি এমন একটি বিজ্ঞান যেটা আপনার মানসিক প্রক্রিয়া, চিন্তা, আবেগ, সমস্যা, সমাধান প্রক্রিয়া, স্মৃতি আর আচার-আচরণ নিয়ে কাজ করে। আর সাইকোলজির কাজ হল এই আচার-আচরণ বোঝা এবং তার কারণ খুঁজে বের করা। স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক আচরণের মাঝে পার্থক্য করা ছাড়াও আরো অনেক কাজ করে থাকে। 

 সমাজ মনোবিজ্ঞানে জনতা বা ক্রাউড (crowed) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলা যায়  মনোবিজ্ঞান চর্চার গোড়ার দিক থেকেই এই বিষয়ের উপর পর্যালোচনা চলে আসছে। ফরাসি লেবো বিজ্ঞানী 1895 সালে “দ্য স্টাডি অফ দ্যা পপুলার” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করলে অনেকেই ক্রাউড বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। 

~ ক্রাউড (crowed)  সাইকোলজি 

জনতা বা ক্রাউড (crowed) হচ্ছে কতগুলো ব্যক্তির সমাবেশ এবং সম্মিলিত আচরণ। তবে ব্যক্তির এই সমাবেশ ও আচরণ আকস্মিকভাবেই হয়ে থাকে। 

মনোবিজ্ঞানী ব্রাউন এর ভাষ্যমতে, এই ক্রাউড (crowed) জনতা উত্তেজিত ও মারমুখো হয়ে যায় সেটা মব (mob) বা সক্রিয় জনতা। আর crowed যখন শান্ত তখন নিষ্ক্রিয় জনতা বা audience বা শ্রোতা।  

audience বা শ্রোতৃবর্গ এর উদাহরণ হিসাবে কোন স্টেডিয়ামে উপবিষ্ট বা কোন বক্তৃতা বা সেমিনারে অংশগ্রহণকারী জনতাকে ধরা যেতে পারে। 

আবার সড়ক দুর্ঘটনার পর লোকের জমায়েত হয়ে উত্তেজিত ভাবে কিছু করা বা হরতালের মাঝের জনতাকে mob বা সক্রিয় জনতার উদাহরণ হিসাবে দেখানো যায়।  

~ মব (mob) সাইকোলজি এর সংঙ্গা :- 

মব সাইকোলজি বলতে বোঝায়,এমন একটি অবস্থা যেখানে কোন দলবদ্ধ মনোভাব বা আচরণ ব্যক্তির নিজস্ব আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে ও নীতিগত বা আদর্শিক চিন্তাভাবনার উপর জয়লাভ করে। 

~ মব (mob) সাইকোলজি এর ব্যাখ্যা:-  

মব (mob) শব্দের অর্থ উত্তাল জনতা। audience বা শ্রোতা হলো এর বিপরীত।  

উত্তাল জনতার একটি মন থাকে একটি চিন্তাধারা থাকে যা আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়, ব্যক্তিমনকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ সাধারণত প্রত্যেক ব্যক্তিরই একটি আলাদা চিন্তা চেতনা থাকে কিন্তু যখন সে কোন এক উত্তাল জনসমাবেশে অবস্থান করে তখন তার সেই নিজস্ব চিন্তা চেতনা লোপ পেতে শুরু করে। আর শুধু চেতন মনের দাসে পরিণত হয় ব্যক্তি। তখন জনসমাবেশে যে হুটহাট সিদ্ধান্ত, চিন্তা চেতনা (সেটা যে কারও থেকেই হোক বা যেভাবেই আসুক) আসে, তা সে গ্রহণ করে। 

এই যে জনসমাবেশের যেসব সিদ্ধান্ত চিন্তা ও ব্যক্তি চিন্তা চেতনার উপর প্রভাব ফেলল এটাকেই মব সাইকোলজি বলে।  

~ জনতার চিন্তা ব্যক্তি চিন্তার উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে :- 

একটি উদাহরণ দিই তাহলে আরেকটু স্পষ্ট হবে। 

আমি একজনকে চিনি - দেশে যখন কোটা সংস্কার এর জন্য আন্দোলন হচ্ছিল তখন তার সে আন্দোলনে সমর্থন ছিল না। কিন্তু রুমমেট, মেসমেট ও অন্যান্য বন্ধুদের আয়োজন, উৎকণ্ঠা ও চাপাচাপিতে শহরে যায় - যেখানে আন্দোলনকারীরা সবাই একত্রিত হয়েছিল। পরে সেও একসময় চিৎকার করে স্লোগান দিতে লাগল,হাত উঁচু করতে লাগল বারবার, রক্ত গরম হয়েছিল,গলা বসে গিয়েছিল স্লোগান দিতে দিতে। পরে বাসায় ফিরে যদিও আফসোস করেছে। ( এখানে কোনটা ঠিক বা ঠিক না সেটা উদ্দেশ্য না। উত্তাল জনতার মাঝে মানসিক অবস্থাটা বিবেচ্য।) 

এখন এই যে একজনের অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও জনতার ভিড়ে গিয়ে তার যে চিন্তা চেতনা ছিল তা ভুলে গিয়েছিল। এবং জনতার চিন্তাটা তার চিন্তার উপর প্রভাব ফেললো। এটাকেই মব সাইকোলজি বলে। এখানে ত ব্যক্তির একটা চিন্তা ছিল আবার এমনও ত হয় আগের থেকে কোন চিন্তা পরিকল্পনা থাকে না, দর্শক হিসাবে আসে এবং ভিড়ের সংস্পর্শে আসলে অটোমেটিক একটি উত্তেজনা কাজ করে। যদিও উপরের ঘটনায় জনতার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য স্থির এবং পূর্ব পরিকল্পিত ছিল।তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  উত্তাল মব জনতার কোন স্থির ও পরিকল্পিত চিন্তা থাকে না। আবার স্মরণ করিয়ে দিই, যেই জনতার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় এবং পরিকল্পিত কাজ করানো হয় তাই অডিয়েন্স। 

~ মব সাইকোলজি এর উদাহরণ:- 

২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে অনেক নিহত হয়।  

বৃটিশ ভারতে কলকাতা, নোয়াখালী, বিহার এ হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা মব সাইকোলজির এক ঐতিহাসিক উদাহরণ।  

এখনও আমরা ভারত উপমহাদেশে দাঙ্গার খবর প্রতিনিয়ত শুনে ও দেখে থাকি।  

~ মব সাইকোলজিতে কী কী হতে পারে:- 

মব (mob) বা উত্তেজিত জনতার দ্বারা হতে পারে মব জাস্টিস (mob justice) ও মব লিঞ্চিং (mob lynching)। 

• মব জাস্টিস (mob justice) 

মব জাস্টিস দ্বারা উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা  নির্ধারিত হওয়া বিচারকে বোঝায়। 

• মব লিঞ্চিং (mob lynching) 

বিচার বহির্ভূত হত্যা। মব লিঞ্চিং দ্বারা বোঝায় উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা কোন বিচার বহির্ভূত হত্যা। 

~মব জাস্টিস কেন হয়:- 

সমাজ মনোবিজ্ঞানীগণ মব জাস্টিস হওয়ার অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করেছেন। অঞ্চল ভেদে কারণ বিভিন্ন হতে পারে যেমন :- আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকাতে বর্ণ বৈষম্য থাকলেও এশিয়াতে নেই বললেই চলে। তাই এখানে সার্বজনীন ও আমাদের অঞ্চল (ভারত উপমহাদেশ) কে প্রাধান্য দিয়ে কারণগুলো উল্লেখ করা হলো। 

• রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা 

• অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য 

• গুজব 

• মানসিক অস্থিরতা 

• মাদকাসক্তি 

• বেকারত্ব 

• সুস্থ বিনোদনের অভাব 

• সহনশীলতার অভাব ইত্যাদি। 

~মব জাস্টিস প্রতিরোধে করণীয়:- 

মব জাস্টিস হওয়ার কারণগুলো এবং যে যে সমস্যা গুলো দেখানো হল সেগুলোর প্রতি কর্তব্যরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খেয়াল রাখার পাশাপাশি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি জোরালো দৃষ্টি দিতে হবে। 

• আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও তৎপরতা বৃদ্ধি 

• আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানো 

• জনগণের স্ব স্ব ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি।